ফসল উৎপাদন ও আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনায় সেচ ও নিষ্কাশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদ্ভিদের বৃদ্ধি, পরিপূর্ণ বিকাশ ও পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় পানি কৃত্রিম উপায়ে মাটিতে সরবরাহ করাকে সেচ বলে । অপরদিকে মাটি থেকে কৃত্রিম উপায়ে অতিরিক্ত পানি ও লবণকে অপসারণ করাকেই নিষ্কাশন বলে । সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা মুলত দুটি পারস্পরিক এবং প্রাকৃতিক পদ্ধতির পরিপুরক । স্থায়ী ও নির্ভরযাগ্য শস্য উৎপাদনের লক্ষে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার অন্যতম পূর্ব শর্ত হচ্ছে সেচ ও নিষ্কাশন মানব সভ্যতার ঊষালগ্নে মানুষ যখন চাষাবাদ শুরু করে তখনই সেচ ও নিষ্কাশনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা পরিচালিত হয়ে আসছে।
ফল গাছে পানি সেচের গুরুত্ব
পানি মৃত্তিকাস্থ খাদ্যোপাদানসমূহকে দ্রবীভূত করে গাছের বিভিন্ন অংগে সঞ্চালন, অংগার (Carbon) আত্মকরণ, শস্যের সজীবতা, প্রয়োজনীয় হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন সরবরাহ প্রভৃতি কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । মাটিতে পর্যাপ্ত রসের অভাব হলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় । বাংলাদেশে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত অধিক হলেও এটি বার মাস সমভাবে বিস্তৃত নয়। ফলে আষাঢ় মাস হতে আশ্বিন মাস পর্যন্ত অতিবৃষ্টি আর কার্তিক হতে জ্যেষ্ঠ মাস পর্যন্ত অনাবৃষ্টির কারণে ফল গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় । উদ্ভিদের জন্য পানি একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান । যখনই পানির অভাব ঘটে তখনই উদ্ভিদে নানারূপ বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং দীর্ঘ সময় পানির অভাব হলে গাছ মারা যেতে পারে । মাটিতে যখন গাছের জন্য প্রয়োজনীয় পানি (মাটির রস) সহজ লভ্য অবস্থায় থাকে না তখন কৃত্রিম উপায়ে গাছে পানি সরবরাহ করা হয় । গাছে কখন কিভাবে কতটুকু সেচ দিতে হবে তা বিভিন্ন অবস্থার ওপর নির্ভর করে । যেমন- আবহাওয়া, মাটির বুনট, গাছের প্রকৃতি, গাছের বৃদ্ধির পর্যায়, বাড়ন্ত ফুল ও ফল অবস্থায়, বয়স্ক গাছ ইত্যাদি ।
ফল গাছের জন্য পানি সেচ অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । ফল গাছ লাগানোর পর দ্রুত বৃদ্ধির জন্য শুকনো মৌসুমে নিয়মিত সেচ দিতে হয় । ফলধারী গাছে প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দেয়া উচিত । বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে ফল গাছ রাপেণে অল্প ক্ষতি হলেও দীর্ঘ সময় অনাবৃষ্টিতে গাছের প্রচুর ক্ষতি হয় । অগভীর মূলবিশিষ্ট গাছের জন্য শুষ্ক মৌসুমে পানি দেয়া বা সেচ আবশ্যক । যেমন- নারিকেল, সুপারী, পেঁপে, আনারস, পেয়ারা, আতা, আর, কলা ইত্যাদি । অপরদিকে গভীর ও অগভীর মূল বিশিষ্ট কিছু সংখ্যক ফল গাছ আছে যেগুলো স্বল্পদিন অনাবৃষ্টিতে তেমন ক্ষতি হয় না । এমনকি জলাবদ্ধতায়ও তেমন কোন অসুবিধা হয় না । যেমন– আম, জাম, গাব, ডেওয়া, চালতা, তাল, খেজুর, লিচু ইত্যাদি ।
ফল গাছে পানি নিষ্কাশনের গুরত্ব
জমিতে যেমন পানি সেচ দেওয়া দরকার তেমনি প্রয়োজন অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা । গাছপালা সুন্দরভাবে জন্মানোর জন্য গাছের গোড়া বা শেকড় অঞ্চল হতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি বের করে দেয়া হলো নিষ্কাশন । পানি জমে থাকলে জলাবদ্ধতা হয়। এতে গাছের প্রয়োজনীয় উপাদান প্রাপ্তিতে নানাবিধ সমস্যা হয় । এমনকি জলাবদ্ধতায় অনেক গাছ মারা যায় । তাই গাছ জন্মানোর জন্য নিকাশন অপরিহার্য ।
কোন কোন ফল গাছ যেমন কাঁঠাল, পেঁপে, আনারস, তরমুজ, কলা ইত্যাদি পানির প্রতি বেশি সংবেদনশীল অর্থাৎ এসব গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকলে গাছের খুব ক্ষতি হয়। এমন কি গাছ মারা যেতে পারে । যেমন— কাঁঠাল গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকলে গাছ মারা যায় । তাই কাঁঠাল বাগানে কোন গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকলে তা জরুরি ভাবে সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। সুন্দরভাবে পানি নিষ্কাশনের জন্য বাগানের চারদিকে নিষ্কাশন নালা থাকা আবশ্যক যেন সেচের অতিরিক্ত পানি বা অত্যধিক বৃষ্টিপাতের ফলে অতিরিক্ত পানি অনায়াসে বের হয়ে যেতে পারে। নিষ্কাশন নালা খাল বা জলাশয়ের সাথে সংযুক্ত করে দিতে হবে।
মাটিতে পানির অভাব হলে যেমন গাছ পালা বাড়তে পারে না। আবার জমি হতে অপ্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত পানি বের করে না দিলেও গাছপালা বাড়তে পারে না ।
ফল গাছে পানি সেচের সময় ও পানির পরিমাণ
জমিতে বা ফলের বাগানে কখন সেচ দিতে হবে এবং কী পরিমাণ সেচ দিতে হবে এ দুটি প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ সেচের পানি প্রদানের লক্ষে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে-
উলেখিত বিষয়গুলো বিবেচনার জন্য মৃত্তিকা, উদ্ভিদ, আবহাওয়া, সেচের পানির উৎস ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত উপাত্ত ও তথ্যাদির প্রয়োজন । মৃত্তিকার যে সব তথ্যাদি বিশেষ ভাবে জানা ও বিশেষণ আবশ্যক সেগুলো হচ্ছে মাটির বুনট, গভীরতা, সংযুক্তি, লবণাক্ততা বা ক্ষারত্ব, বায়বীয়তা, নিষ্কাশন, অনুপ্রবেশ, অনুস্রবণ, চুয়ানো, ভূগর্ভস্থ পানি তলের গভীরতা এবং পানি ধারণ ক্ষমতা ইত্যাদি ।
উদ্ভিদ সম্পর্কিত জরুরি তথ্যাদি হচ্ছে ফসলের প্রকার, শেকড়ের বৈশিষ্ট্য, বর্ধনের সময় বিভিন্ন ধাপে পানির ব্যবহার, মৃত্তিকায় পানি স্বল্পতার কারণে উদ্ভিদের যে ধাপ সর্বাধিক ক্ষতিগত হয় ইত্যাদি ।
আবহাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে চাষাবাদের ঐতিহ্যগত পদ্ধতি বীজ বপন অথবা চারা রোপণের তারিখ, গাছের ঘনত্ব, সারির দূরত্ব, সার ব্যবহার, আগাছা অথবা পাকামাকড় নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ।
উদ্ভিদের ক্ষরা সহনীয়তা বলতে বোঝায় মৃত্তিকাস্থ শেকড় অঞ্চলে যে পরিমাণ সঞ্চিত পানি (%) গাছ ব্যবহার করলে গাছের বিশেষ কোন ক্ষতি হয় না । অধিকাংশ ফসলের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, গাছ মৃত্তিকায় সঞ্চিত পানির ৫০% ব্যবহার করার পরে যদি সেচ দেয়া হয় তাহলে ফসল উৎপাদনের মাত্রা কমে যায় না। এ ক্ষেত্রে সেচকে বলা হয় মৃত্তিকাস্থ প্রাপ্য পানির ৫০% কমতিতে সেচ প্রদান । কোন কোন ফসলের ক্ষেত্রে ৭৫% পানি কমতিতে ও ফসলের উৎপাদনের ক্ষতি হয় না। তবে ৫০% মাত্রাকেই সাধারণ সেচের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। তিনটি প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে সেচের সময় ও পরিমাণ নির্বাচন করা যায় যথা—
ক) মৃত্তিকা সম্পর্কিত
খ) উদ্ভিদ সম্পর্কিত
গ) আবহাওয়া সম্পর্কিত
ক) মৃত্তিকা সম্পর্কিত
এ পদ্ধতিতে প্রধানত মাটিতে পানির প্রাপ্যতা মাপা হয়। জমি থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহের সময় মনে রাখতে হবে যেন এই নমুনা যে জমি থেকে মাটি নেয়া হবে মোটামুটিভাবে সেই জমির মাটির প্রতিনিধিত্ব মূলক হয় । এক্ষেত্রে অনুভব পদ্ধতি এবং অন্যান্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে মাটিতে পানির প্রাপ্যতা নির্ধারণ করা যায়।
১ । অনুভব পদ্ধতি (Feel Method)- এ পদ্ধতিতে মৃত্তিকার অবস্থা দেখে এবং স্পর্শ করে মৃত্তিকার পানির পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা করা হয়। মৃত্তিকার পানি ধারন বা রসের পরিমাণ নির্ণয় করার জন্য ফসল ভেদে ৩০-১০০ সে:মি: নিচ থেকে অথবা সংশিষ্ট ফসলের শেকড়ের গভীরতার ৬০-৭০% নিচ থেকে মাটি খুঁড়ে মাটির নমুনা সংগ্রহ করা হয় । সংগৃহীত নমুনা থেকে এক মুঠো মাটি হাতের মুঠিতে চেপে বল বানানো হয় এবং স্পর্শের অনুভূতি ও অবস্থা সারণি-১ প্রদত্ত অবস্থার সাথে তুলনা করে পানি সেচের উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করা যায় ।
সারণি-১ হাতের সাহায্যে মৃত্তিকার পানির পরিমাণ পদ্ধতি ও সেচের সময় নির্ধারণ
মুক্তিরসের পরিমাণ (পানিধারন ক্ষমতার অংশ % | সূক্ষ্ম বুনটের মৃত্তিকা (এটেল মৃত্তিকা, পলি এটেল প্রভৃতি) | মধ্যম থেকে মোটা বুনটের মৃত্তিকা | ||
মৃত্তিকা অবস্থা | করণীয় ব্যবস্থা | মৃত্তিকা অবস্থা | করণীয় ব্যবস্থা | |
০-২৫ | খুব শুষ্ক | অতি সত্ত্বর সেচের ব্যবস্থা করতে হবে | খুব শুষ্ক | অতি সত্ত্বর সেচের ব্যবস্থা করতে হবে |
২৬-৫০ | হাতের মুঠোয় চাপ দিলে দলা বেঁধে যায় এবং চাপ দেয়ার সাথে সাথে গুড়ো গড়ো হয়ে যায়। | অতি সত্ত্বর সেচের ব্যবস্থা করতে হবে | হাতের মুঠোয় চাপ দিলে দলা বাধে না | অতি সত্ত্বর সেচের ব্যবস্থা করতে হবে |
৫১-৭৫ | হাতের মুঠোয় চাপ দিলে শক্ত ও কিছুটা আঠালো দলা বাধে এবং ফেলে দিলে ভাঙ্গে না। | ২-৩ দিন পর সেচ দিলেও চলে | হাতের মুঠোয় চাপ দিলে দলা বাধে, ফেলে দিলে দলা ভেঙ্গে গুড়ো হয়ে যায়। | ১-২ দিন পর সেচের ব্যবস্থা করতে হবে |
৭৬-১০০ | হাতের মুঠোয় চাপ দিলে দলা বাধে এবং তালু ভিজে যায়, কিন্তু রস বের করে না ফেলে দিলে দলা ভাঙ্গে না। | ২-৩ দিন পর সেচ দিতে হবে | হাতের মুঠোয় চাপ দিলে দলা বাধে পানি বের হয়না ফেলে দিলে দলা ভাঙ্গে যায়। | ২-৩ দিন পর সেচের ব্যবস্থা করতে হবে |
১০০ | কাদা মাটি হাতের মুঠোয় চাপ দিলে আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে মাটি বের হয়ে আসে। | সেচ দিতে হবে না । অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। | হাতের মুঠোয় চাপ দিলে ভেজা দলা বাধে। তালু ভিজে যায়, কিন্তু পানি বের হয়ে আসে না। | সেচ দিতে হবে না। ৭দিন পর পুনঃ মাটি পরীক্ষা করে ব্যবস্থা নিতে হবে । |
খ। উদ্ভিদ সম্পর্কিত পদ্ধতি
উদ্ভিদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেও সেচের প্রয়োজনীয়তা বোঝা যায় । যখন মৃত্তিকাস্থ পানির পরিমাণ কমে যায় তখন গাছের পাতার রং বদলে যেতে পারে (যেমন— সবুজ থেকে হলুদ বর্ণ ধারণ), পাতা কুঁকড়িয়ে যেতে পারে । এ ছাড়াও গাছের বৃদ্ধির হার কমে যেতে পারে । কোন উদ্ভিদের এ জাতীয় উপসর্গ সেচের আবশ্যকতা নির্দেশ করে । তবে এই পদ্ধতির সমস্যা এই যে, এ সমস্ত উপসর্গ দেখা দেয়ার বেশ আগেই গাছ অতিরিক্ত পানি পীড়নের শিকার হয়, ফলে গাছের যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে যায় এবং ফলন কমে যায় ।
গ। আবহাওয়া সম্পর্কিত পদ্ধতি
এ পদ্ধতিতে আবহাওয়ার বিভিন্ন দিক যেমন- বৃষ্টিপাত, সোলার রেডিয়েশন, তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আর্দ্রতা, বাষ্পীভবন ইত্যাদি মাপা হয়। সেই সাথে বিভিন্ন গাণিতিক সমীকরণ নির্ণয় করা হয়। বাষ্পীয় প্রস্বেদন, বৃষ্টিপাত, অনুপ্রবেশ, চুয়ানোসহ অন্যান্য অপচয় ইত্যাদির ভিত্তিতে সেচের আবশ্যকতা ও সময় নির্ধারণ করা যায়।
সেচের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলোর বর্ণনা
জমিতে সেচের পানি বিভিন্নভাবে প্রয়োগ করা যায়। ফসলের পানির প্রয়োজনীয়তা, পানির উৎস ও প্রাপ্যতা, পানির গুণাগুণ, মাটির প্রকার, জমির অবস্থান, চাষাবাদের ধরন ইত্যাদির ভিত্তিতে সেচের পদ্ধতি নির্বাচন করা হয় । আধুনিক সেচ পদ্ধতিকে ৪ ভাগে ভাগ করা যায় যথা-
১। ভূ - উপরিস্থ (Surface)
২। ভূ- মধ্যপ্ত ( Sub-surface)
৩। স্প্রিংকলার (Sprinkler)
৪ । ট্রিকল (Trickle)
১। ভূ - উপরিস্থ সেচ পদ্ধতি (Surface irrigation system)
এ পদ্ধতিতে পানি সরাসরি জমিতে দেয়া হয় ও সেচের পানি জমির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় । এক্ষেত্রে জমিতে কয়েক সে:মি: পানি দিয়ে প্লাবিত করা হয় । পানির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জমিকে প্রথমে মসৃন এবং পরে জমিতে বর্ডার (পাড় বা কিনার) ফারো (লাঙলের ফলার গভীর দাগ), করোগেশন (ঢেউ খেলানে আকৃতি) ইত্যাদি তৈরি করা হয় ।
ভূ-উপরিস্থ সেচ পদ্ধতিকে নিম্নলিখিত ৩ ভাগে ভাগ করা যায় ।
১। অনিয়ন্ত্রিত পাবন পদ্ধতি (Uncontrolled flooding)
২। নিয়ন্ত্রিত প্লাবন পদ্ধতি (controlled flooding)। এ পদ্ধতি আবার ৩ প্রকার । যেমন—
ক) বর্ডার স্ট্রিপ (Border Strip)
খ) চেক প্লাবন (Check flooding)
গ) বেসিন (Basin)
৩ । ফারো পদ্ধতি (Furrow Method)। এ পদ্ধতি আবার ২ প্রকার । যেমন-
ক) ফারো (Furrow)
খ) করোগেশন (Corrugation)
১। অনিয়ন্ত্রিত প্রাথম পদ্ধতি (Uncontrolled flooding)
যখন নালা থেকে পানি কোন রকম বাঁধ অথবা ডাইক অথবা অন্য কোন রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই জমিতে দেয়া হয় তখন তাকে অনিয়ন্ত্রিত প্লাবন পদ্ধতি বলে। যেখানে অত্যন্ত সপ্তায় প্রচুর পরিমাণে সেচের পানি পাওয়া যায় সেখানে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
সুবিধা
অসুবিধা
২। নিয়ন্ত্রিত প্লাবন পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে যুক্ত প্লাবনের পানিকে নিয়ন্ত্রণ বা বাধ দিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রবাহিত করা হয়।
ক) বর্ডার স্ট্রিপ পদ্ধতি (Border strip )
এ পদ্ধতিতে মাঠকে অনেক গুলো খণ্ড বা ভাগে বিভক্ত করা হয়। এই খণ্ডগুলো সাধারণত ১০-২০ মি: প্রশস্ত ও ১০০-৪০০ মিটার লম্বা হয়। একটি খণ্ড থেকে অন্য খও নিচু বাধ যারা বিচ্ছিন্ন করা হয় । সরবরাহ
নালা থেকে পানি এই খণ্ডসমূহে সরবরাহ করা হয়। পানি নিচের দিকে প্রবাহিত যে সমস্ত খণ্ডের জমিকেই ভিজিয়ে দেয় । প্রতিটি খন্ডে আলাদাভাবে সেচের পানি দেয়া হয়। সব ধরনের মৃত্তিকাতেই এই পদ্ধতিতে সেচ দেয়া যায়।
খ. চেক পাবন পদ্ধতি (Check Flooding) এ পদ্ধতিতে চারদিকে নিচু বাঁধ দ্বারা ঘেরা তুলনামূলক সমতল জমিতে বেশি পানি দেয়া হয় । অত্যন্ত পরিশোষক মৃত্তিকার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি বেশি উপযোগী । এছাড়াও ভারি মৃত্তিকা যেখানে পানির হার কম সেখানেও এ পদ্ধতি কার্যকর । বতুত এই পদ্ধতি বর্ডার স্ট্রিপ পদ্ধতির একটি রূপান্তর ।
গ) বেসিন পদ্ধতি
নিচু বাঁধ দ্বারা পরিবেষ্টিত সমতল জমিতে দ্রুত পানি দেয়া হয় এবং জমি শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত পানি ধরে রাখা হয় । ধান চাষের জন্য এ পদ্ধতি বহুলভাবে ব্যবহৃত হয় । এ ছাড়াও ফল বাগানে সেচ প্রদানের জন্য এ পদ্ধতি বিশেষ উপযোগী । একটি বেসিনের আওতায় ১ থেকে ৫ অথবা বেশি পরিমাণ সেচ দেয়া হয় ।
সুবিধা
অসুবিধা
৩। ফারো পদ্ধতি
ফারো পদ্ধতি দু ধরনের যথা ফারো ও করোগেশন
ক) ফারো: ফারো পদ্ধতিতে শস্য/গাছের সারির মধ্যবর্তী ফারোতে (ছোট নালা) পানি সরবরাহ করা হয় । নালা গুলো সাধারণত প্রায় সমুন্নত ভূমি অথবা জমির ঢাল অনুযায়ী করা হয় । যে সমস্ত শস্য সারিবদ্ধ ভাবে চাষ করা হয় তাদের জন্য এ পদ্ধতি বিশেষ উপযোগী ।
খ) করোগেশন। এটি কারো পদ্ধতিরই একটি রূপান্তরিত অবস্থা। এ পদ্ধতিতে পানি ছোট নালায় দেয়া হয়। এবং এই নালাগুলো সমস্ত মাঠ জুড়ে নির্মাণ করা হয়। পানি এই নালার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং চুইয়ে দুই নালার মধ্যবর্তি এলাকাতে সেচ প্রদান করে ।
সুবিধা
অসুবিধা
২। ভু - মধ্যস্থ সেচ পদ্ধতি - এই পদ্ধতিতে মাটির বুনট এবং ফসলের শেকড়ের গভীরতার ভিত্তিতে ভূ-পৃষ্ঠের নিচে পানি প্রবাহিত করা হয় । এ প্রক্রিয়ায় পানি শেকড় অঞ্চলে পৌঁছায়। গভীর নালা, মাটিতে প্রোষিত সিমেন্ট বা ধাতু নির্মিত ছিদ্র যুক্ত পাইপ, টাইল, ড্রেন ইত্যাদির মাধ্যমে ভূ-পৃষ্ঠের নিচে গাছের শেকড় অঞ্চলে পানি সরবরাহ করা হয়। অর্থাৎ এ পদ্ধতিতে ভূ-অভ্যন্তরে এমন একটি কৃত্রিম পানির তল তৈরি করা হয় যেখানে গাছ প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করতে পারে ।
সুবিধা
অসুবিধা
৩। স্প্রিংকলার বা ছিটানো পদ্ধতি/সিঞ্চন পদ্ধতি
এই পদ্ধতিতে পানি পাইপ ও স্পিংকলার নজল-এর মাধ্যমে বাতাসে ছড়িয়ে দেয়া হয় এবং তা বৃষ্টির মতই মাটিতে পড়ে। এ পদ্ধতি প্রায় সব রকম ফসল ও মৃত্তিকার জন্যই উপযোগী।
সুবিধা
অসুবিধা
৪। ট্রিকল বা ড্রিপ পদ্ধতি
এটি ড্রিপ পদ্ধতি হিসেবেও পরিচিত। এ পদ্ধতিতে ছোট ব্যাসযুক্ত পাইপের একটি বিস্তারিত নেটওয়ার্ক থাকে। যার দ্বারা পানি সরাসরি গাছের গোড়ায় ফোটায় ফোটায় দেয়া হয়। এই পদ্ধতি ফল বাগান ও গ্রীন হাউসের জন্য বিশেষ উপযোগী।
সুবিধা
অসুবিধা
নিষ্কাশনের বিভিন্ন পদ্ধতি: নিষ্কাশন নালা বা নর্দমার মাধ্যমে ফসলের শেকড় অঞ্চল থেকে অপ্রয়াজনীয় বা অতিরিক্ত পানি বের করে দেয়াকে নিষ্কাশন বলে । নিষ্কাশন নালা প্রধানত দুধরনের হয় প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম । কার্য পদ্ধতি অনুসারে নিস্কাশন নালা তিন প্রকার । যথা -
(১) ভূ -- পৃষ্ঠস্থ নিষ্কাশন ব্যবস্থা (Surface)
(২) ভূ নিম্নস্থ নিষ্কাশন নালা ( Sub - Surface or tile)
(৩) সম্মিলিত ভূ-পৃষ্ঠস্থ ও ভূ-নিম্নস্থ নিষ্কাশন নালা (Combinaton of surface and sub- surface drains)
(১) ভূ-পৃষ্ঠস্থ নিষ্কাশন নালা
যে সমতল জমিতে উপরিস্তরের গভীরতা কম এবং ভূ-পৃষ্ঠের অল্প নিচেই অপ্রবেশ্য স্তর যেমন- লাঙল তল, শক্ততল বা এটেল মাটির স্তর রয়েছে সে সব জমির জন্য ভূ-পৃষ্ঠসহ নিষ্কাশন নালা উপযোগী ।
ভূ-পৃষ্ঠস্থ নিষ্কাশন নালা তিন রকমের । যেমন-
ক) স্টর্ম নিষ্কাশন ব্যবস্থা বা গভীর নালা ব্যবস্থা
খ) চুয়ানো নিষ্কাশন ব্যবস্থা
গ) সম্মিলিত স্টর্ম ও চুয়ানো নিষ্কাশন ব্যবস্থা
ক) স্টর্ম বা গভীর নিষ্কাশন নালা- এ নালা সাধারণত অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি নির্দিষ্ট সময়ে বের করে দেয়ার জন্য গভীর করে তৈরি করা হয় ।
(খ) চুয়ানো নিষ্কাশন নালা ( Seepage drain): সেচ নালার বা খালের পানি পাশের জমির চেয়ে উঁচু দিয়ে প্রবাহিত হলে পাড় চুঁইয়ে জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে । চুয়ানো পানি নিষ্কাশনের জন্য সেচ খালের পাড়ের পাশেই চুয়ানো খাল খনন করা হয় । খাল গভীর করে খনন করতে হয় । চুয়ানো পানি জমা হলে এখান দিয়ে নিকাশিত হয় ।
(গ) সম্মিলিত স্টর্ম ও দুয়ানো নিষ্কাশন নালা- এ নালা প্রথমে চওড়া ও অগভীর করে তৈরি করে মাঝখান দিয়ে কম চওড়া করে অগভীর নালা করা হয় । এতে বৃষ্টির পানি এবং চুইয়ে আসা পানি উভয়ই বের হতে পারে ।
ভূ- পৃষ্ঠস্থ নিষ্কাশন নালা ব্যবস্থার প্রকার
পাঁচ ধরনের ভূ-পৃষ্ঠস্থ নিষ্কাশন নালা ব্যবস্থা আছে। ফসল ক্ষেত্রের অবস্থা বিবেচনা করে এ পাঁচ প্রকার ব্যবস্থা থেকে দুটি বা ততোধিক ব্যবস্থা সম্মিলিতভাবে ব্যবহার করতে হতে পারে। ব্যবস্থাগুলো নিম্নরূপ-
ক) এলাপোথাড়ি নালা ব্যবস্থা (Random drain)
খ) প্রবাহ পথে অটককরণ নালা ব্যবস্থা (Interception)
গ) ভিন্নদিকে প্রবাহিতকরণ নালা ব্যবস্থা (Diversion)
ঘ) উপরিভাগ নালা ব্যবস্থা (Bedding)
ও) মাঠ নালা ব্যবস্থা (Field drain)
২। ভূ-মধ্যস্থ বা ভূ-নিম্নস্থ নিষ্কাশন ব্যবস্থা/টাইল (Sub Surface or tile): এ পদ্ধতিতে মাটির অভ্যন্তর থেকে পানি টাইল অথবা মোন (Tilte or mole) নালার মাধ্যমে নিষ্কাশন করে ভু-গর্ভস্থ পানির তল গাছের শেকড় অঞ্চলের নিচে নামানো হয়। এই নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে টাইল নিষ্কাশন ব্যবস্থাও বলে। এই নিষ্কাশন ব্যবস্থার ভূ-পৃষ্ঠের নিচে নিষ্কাশন নালা স্থাপন বা তৈরি করা হয়। ভূগর্ভস্থ পানি তলের অবস্থান গাছের শেকড় থেকে পতীরে নামিয়ে শেকড়ের পর্যাপ্ত বৃদ্ধি ও শেকড় অঞ্চলে প্রয়োজনীয় বায়ু চলাচলের সুবিধার জন্য এ নিষ্কাশন ব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকরি। বাংলাদেশে উঁচু জমিতে আবাদকৃত ফসলের জন্য এই ধরনের নিষ্কাশন নালা ব্যবহার করা যেতে পারে।
বিভিন্ন উপযোগিতা বিবেচনায় টাইল নালা পদ্ধতিতে কয়েক ধরনের বিন্যস্ততা দেখা যায়। সাধারণ টাইল নিষ্কাশন পদ্ধতিসমূহ হলো-
১ । ইন্টারসেপশন (Interception)
২। র্যানডম (Random)
৩ । ডাবল মেইন (Double main )
৪ । পারালাল (Parallel )
৫ । গ্রিড আয়রন (Gridiron )
৬। হেরিং বোন (Herring bone)
(৩) সম্মিলিত ভূ-পৃষ্ঠস্থ ও ভূ-নিম্নস্থ বা ভূ-মধ্যস্থ নিষ্কাশন ব্যবস্থা
এই পদ্ধতিতে উপরে বর্ণিত উভয় প্রকার নিষ্কাশন পদ্ধতি একত্রে ব্যবহার করা হয় । এ ব্যবস্থায় ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি নিষ্কাশনের নালার তল মাটির নিচে নিষ্কাশন নালা তৈরি করা যায় । এ নালার চতুর্দিকে ফিল্টার দ্রব্য ব্যবহার করা হয় ।
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। স্থায়ী ও নির্ভরযোগ্য শস্য উৎপাদনের লক্ষে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার অন্যতম পূর্বশত হলো কী ?
২ । কোন কোন ফল গাছ সেচের প্রতি বেশি সংবেদনশীল ।
৩ । অনুভব পদ্ধতি কী ?
৪ । আধুনিক সেচ পদ্ধতিতে কত ভাগে ভাগ করা যায় ?
৫। একটি বেসিনের আওতায় কতটি গাছকে সেচ দেয়া যায় ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। পানি সেচ বলতে কী বোঝায় ।
২ । সেচের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলোর নাম লেখ ।
৩ । নিষ্কাশনের গুরুত্ব বর্ণনা কর ।
৪ । নিষ্কাশনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা কর ।
৫ । ফল বাগানে সেচের গুরুত্ব বর্ণনা কর ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১ । সেচের প্রধান পদ্ধতিগুলোর নাম উল্লেখ সহ যে কোন একটি পদ্ধতির সুবিধা ও অসুবিধা লেখ ।
২। পানি নিষ্কাশনের উদ্দেশ্য এবং সুবিধা অসুবিধা লেখ ।
৩ । বাগানে সেচের প্রয়াজনীয়তা নির্ধারণের বিষয়গুলো বর্ণনা কর ।
৪ । ফল বাগানে পানি সেচের গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর ।
৫ । নিষ্কাশনের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলোর বিবরণ দাও ।
আরও দেখুন...